রংপুর অঞ্চলে প্রচন্ড তাপদাহের কারণে রোপনকৃত আগাম জাতের আমন ধানে চিটা দেখা যাচ্ছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন প্রান্তিক কৃষকরা। স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় রোপা আমনসহ অন্যান্য ফসল এখন পুরোপুরি সেচনির্ভর হয়ে পড়েছে। অপরিকল্পিত সেচযন্ত্র ব্যবহারের ফলে কৃষকদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি খরচ। বাড়তি খরচ করেও লোকসানের পথে তারা।
রংপুরে কয়েকদিন ধরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত কয়েকদিন ধরে এমন অবস্থা বিরাজ করায় মাঝারি তাপপ্রবাহ চলছে এই অঞ্চলে। সেই সাথে আগস্ট মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল ৩৭৮ মিলিমিটার। সেখানে হয়েছে মাত্র ২৮৮ মিলিমিটার। স্বাভাবিকের চেয়ে ৯০ মিলিমিটার বৃষ্টি কম হয়েছে বৃষ্টিপাত। সেপ্টেম্বরর মাসের গত ২৪ দিনের মধ্যে বৃষ্টি হয়েছে ৬ দিনে ৮২ মিলিমিটার। যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম। ফলে কম বৃষ্টির কারণে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, রংপুর জেলায় চলতি বছর এক লাখ ৬৬ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন চাল। এরমধ্যে কৃষকরা মোট আবাদের ৩০ ভাগ জমিতে আগাম জাতের ধান রোপন করেছেন। রংপুর অঞ্চলে কয়েকদিন থেকে টানা তীব্র তাপদাহের কারণে ক্ষেতের ধানে চিটা হচ্ছে। আগাম রোপন করা ধানের ক্ষেতে এই চিটা দেখা যাচ্ছে । বেশিরভাগ ক্ষেতে ধানের শীষ কালো হয়ে চিটা হয়ে যাচ্ছে। এতে করে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
রংপুর জেলার গঙ্গাচড়ার তিস্তার চরাঞ্চলের কৃষকরা প্রতিবছরের মতো এবারেও বাড়তি লাভের আশায় আলু, মিষ্টি কুমড়াসহ আগাম শীতকালীন শাকসবজি চাষের জন্য আগাম জাতের রোপা আমন ধান চাষ করেছেন। ক্ষেতে নিয়মিত সার, সেচ, নিড়ানি, কীটনাশক প্রয়োগও করেছে। এখন সেই ধানে শীষ বের হচ্ছে। তবে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে বের হওয়া সেই স্বপ্নের ধানের শীষ কালো হয়ে চিটা হয়ে যাচ্ছে। শেষ সময়ে কীটনাশক দেয়ারও সুযোগ নেই। যার কারনে লোকসানের মুখে কৃষকরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। লাভের আশায় আগাম ধান রোপন করে এখন আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থের মুখে তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মিটারী ইউনিয়নের মহিপুর এলাকায় প্রায় ধান ক্ষেতে এমন চিত্র। বৃষ্টি কম হওয়ায় শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে পর্যাপ্ত সেচ দিয়েও কোন ভালো ফল মিলছে না। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারনেই ধানে চিটা হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
ভুক্তভোগি কৃষক দিলদার হোসেন জানান, প্রতিবছরের মতো এবারেও আগাম জাতের আমন ধান কেটে আগাম আলু রোপনের আশায় তিন একর জমি লিজ নিয়েছেন। রোপন করা ধানের ক্ষেতে কয়েক দফা সেচও দিয়েছেন। সার দেয়ার পাশাপাশি কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়েছে সময়মতো। শুরু থেকে সবকিছু ঠিকই ছিল। কিন্তু শীষ বের হওয়ায় পর দেখা যাচ্ছে প্রায় ধান চিটা হয়ে গেছে। ধানে চিটা হওয়ায় অনেক লোকসান হয়েছে তার। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আর সামর্থ্য নেই বলে জানান তিনি।
আগাম জাতের ধান রোপন করেছেন ওই এলাকার মিরাজ, আলমগীর, দুলাল মিয়া, রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই। প্রায় সবারই একই শঙ্কায় ভুগছেন। প্রবীণ কৃষক মনির উদ্দিন বলেন, খরার কারণে ক্ষেতে দফায় দফায় সেচ দেয়া হয়েছে। সেচে বাড়তি অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখন ধানে কেবল শীষ বের হচ্ছে। পরে ধানের কী অবস্থা হয় আল্লায় জানে। অনেকের তো ধান চিটা হয়ে গেছে। এরকম ধানে চিটা হলে, না খেয়ে মরা ছাড়া উপায় নাই।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান বলেন, ধানের পরাগায়ন সময়টাতে তাপমাত্রা বেশি হলে চিটা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। গবেষণামতে সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ধানের পরাগায়ন ভালো হয়। আগাম ধানের পরায়গনের এই সময়টাতে রংপুরে ৩৭ থেকে ৩৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা বিরাজ করছে। এই সময়টাতে প্রচুর সেচ দিতে হবে। সেচের ঘাটতি হলে চিটা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুরের উপপরিচালক বলেন, স্বাভাবিক সময়ও ধানের চিটা হয় কিন্ত সেটার পরিমাণ খুবই কম হয়ে থাকে। আর তাপমাত্রা বেশি হলে ধানে চিটা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বর্তমানে যে তাপমাত্রা এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এটাতে কিছুই করার নেই। তবে খরায় ধানক্ষেতে সেচ দেওয়ার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারা কাজ করছেন। যাতে ধানে চিটার পরিমাণ কম হয়। কৃষকদের লোকসান কম হয়।