পঞ্চগড়ে প্রাণি সম্পদ এবং ডেইরি উন্নয়নে দৃশ্যমান কোন ভূমিকা নেই। দুধ সংগ্রহ ও বিপননে ডেইরি হার্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এগিয়ে যেতে পারছে না এই প্রকল্প। ফলে সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও খামারিরা সফল হতে পারছে না। পঞ্চগড় জেলার ৫টি উপজেলায় ডেইরি প্রতিষ্ঠা করে দুধ উৎপাদনের যথেষ্ট সম্ভবনা থাকলেও প্রাণি সম্পদ বিভাগের রুগ্ন কার্যক্রমে সকল সম্ভবনা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
সরকারের গৃহীত নানা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক এই জনপদে ডেইরি উন্নয়নে খামারিদের সাবলম্বী করতে আর্থিক প্রণোদনাসহ নানা সুযোগ সুবিধায় প্রাণি সম্পদের অগ্রণী ভূমিকা রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।
খামারিদের অভিযোগ, পশুর চিকিৎসায় সরকারী কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, যাবতীয় পৃষ্ঠোপোষকতার অভাব, কর্মকর্তাদের অনিয়ম দুর্নীতি, ঔষধসহ গোখাদ্যের চড়া দাম এবং ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধা না থাকায় প্রান্তিক পর্যায়ে খামারি গড়ে উঠছে না। এসব সমস্যা দূর করা গেলে বাড়বে খামারির সংখ্যা। উৎপাদন হবে দুধ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি দুধ অন্য জেলায় সরবরাহ নিশ্চিত বলে জানিয়েছে খামারিরা। অনুকুল আবহাওয়া, প্রাকৃতিক পরিবেশ রোগ বালাইয়ের প্রকোপ কম থাকায় ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে ডেইরিতে। উদ্দোক্তাদের সংগঠিত করতে পারলে এই জেলা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করা সম্ভব।
এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নসহ সাধারণ মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে অধিদপ্তরের গৃহীত সকল পদক্ষেপ তরান্বিত করতে পঞ্চগড় জেলায় ডেইরি প্রকল্প জোরদার করার যথেষ্ট পরিবেশ রয়েছে। কিন্ত সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনিয়ম দুনীতি, জনবলের অভাব, ঔষধসহ পশুর চিকিৎসা ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি না থাকায় এই প্রকল্প বর্তমানে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দুধ, ঘি, পনির, মিষ্টি, চিজসহ বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন বিপনন এবং সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষে বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় প্রাণি সম্পদ বিভাগ ইতিমধ্যে সক্ষমতা যাচাইয়ের মাধ্যমে সারাদেশে ১৩টি ডেইরি হার্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালে পঞ্চগড় জেলায় পঞ্চগড় ডেইরি হার্ব নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। প্রাণি সম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প’র ম্যাচিং প্লান্টের আওতায় ভিলেজ মিল্ক কালেকশনের মাধ্যমে দুধ সংগ্রহের এই প্রকল্প সরাসরি খামারিদের নিকট থেকে ন্যায মূল্যে দুধ ক্রয় করে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন এবং দুধ সরবরাহ করবে। এই ক্ষেত্রে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশিদারিত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষে অধিদপ্তরের এলডিডিপি প্রকল্প সক্ষমতার ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও নানা জটিলতায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমূদয় বরাদ্দ না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। ফলে অর্থের অভাবে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম পুরোপুরি চালু করতে পারছে না।
পঞ্চগড় ডেইরি হার্ব এর সত্ত্বাধীকারী জান্নাতুল ফেরদাউস নির্ঝর জানান, প্রাণি সম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এলডিডিপি প্রকল্পের অধীনে পঞ্চগড় ডেইরি হার্ব নামে তার প্রতিষ্ঠানটিতে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার বরাদ্দ মিলেছে। তার এই ডেইরিতে ৫০ হাজার লিটার দুধ সংরক্ষণ করার সক্ষমতা রয়েছে। প্রথম দু’ধাপে তাকে ৯০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রস্তাবিত সকল প্রকার মেশিনারীজ ক্রয় এবং স্থাপন করা হলেও এখন পর্যন্ত বাকি অর্থ না পাওয়ায় উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি জেলার প্রায় ২শ’ খামারির নিকট থেকে গড়ে ৫ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করছে। তার এই সংগ্রহকৃত দুধ প্রাণ কোম্পানি, বিজিবি, স্থানীয় চিজ ফেক্টরিসহ নিজস্ব মোড়কে পাস্তরিত প্যাকেটজাত হয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
এই ডেইরি হার্ব এর মালিক জানান, পঞ্চগড় জেলায় ডেইরি খামারের উজ্বল ভবিষ্যত রয়েছে। ইতিপূর্বে ক্ষুদ্র খামারিরা তাদের উৎপাদিত দুধ বিক্রি করতে পারতো না। বর্তমানে আর এই সমস্যা নেই পঞ্চগড় ডেইরি হার্ব খামারীদের ন্যায মূল্য দিয়ে দুধ ক্রয় করছে। প্রান্তিক পর্যায়ে অনেক মানুষ খামার করতে আগ্রহী। কিন্ত অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তারা এগিয়ে আসতে সাহস পায় না। এই ক্ষেত্রে স্থানীয় এনজিওসহ ব্যাংকগুলো স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করলে খামারির সংখ্যা বাড়বে। উৎপাদন হবে দুধ। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকদের মনিটরিং প্রয়োজন।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নে সফল খামারি জুয়েল ইসলাম জানান, পঞ্চগড় জেলায় বর্তমানে যে সব খামারি রয়েছে তাদের এখন ভাল সময় যাচ্ছে না। প্রাণি সম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে খামারিরা কোন প্রকার সহায়তা পায় না। পশুর চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় বিষয়ে তাদের ডাকলেও আসে না। এলেও চড়া ভিজিট দিতে হয় তাদের। সরকারী ঔষধ বাজারে বিক্রি হচ্ছে, হাসপাতালে জরুরি সেবা বলতে কিছু নেই। অধিকাংশ সময়েই কর্মকর্তাদের অফিসে পাওয়া যায় না। খামারে অসুস্থ হয়ে পশু মারা গেলেও তারা কখনো খোজ খবর রাখে না। পশুর খাবারসহ ঔষধপত্রের দাম না কমাতে পারলে খামার চালানো কঠিন।
জিয়াবাড়ি গ্রামের প্রান্তিক নারী খামারি মাহমুদা খাতুন জানান, একটি মাত্র গাভী দিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন। এখন তার বেশ কয়েকটি গাভী রয়েছে। এই খামারের আয় দিয়ে দুই সন্তানের পড়ালেখাসহ সংসার চালিয়ে তিনি এখন সাবলম্বী। তার অভিযোগ প্রাণি সম্পদের নিকট থেকে কোন সহায়তা পান না। আগে দুধ বিক্রি নিয়ে জটিলতা হতো, এখন ডেইরি হার্ব তার বাড়ি থেকে দুধ নিয়ে যায় , দামও পান ন্যায।
পঞ্চগড়ের স্থানীয় এনজিও ইএসডিও এর ব্যবস্থাপক আল মামুনুর রশীদ জানান, আমরা এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিকে অধিকতর অগ্রাধিকার দিতে ইতিমধ্যে ২শ’ প্রান্তিক নারীকে গাভী পালন করে সাবলম্বী করতে প্রায় ৬ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করেছি। আমাদের এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
জেলা প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. বাবুল হোসেন জানান, জেলার ডেইরি প্রকল্পসহ প্রাণি সম্পদ এর পরিধি বাড়াতে আমরা কাজ করছি। ঔষধসহ চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরিমিত বাজেটের মধ্যেই আমাদের সব কিছু সামলাতে হয়। সবচেয়ে বড় অন্তরায় ম্যানপাওয়ার ও পরিবহন। সীমিত সংক্ষক লোকবল দিয়ে সবার চাহিদা মিটানো সম্ভব হচ্ছে না, সুতরাং অভিযোগ থাকবেই।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলী জানান, আমাদের অর্থনীতির একটি বড় খাত হলো প্রাণি সম্পদ। এই সম্পদকে যুগপোযোগী করতে সরকার নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রশাসন থেকে আমরা এসব মনিটরিং করছি। এই জেলার প্রাণি সম্পদ সংরক্ষণ এবং সম্প্রসারণে অচিরেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
প্রতিবেদনঃ আব্দুল্লাহ্ আল মামুন,পঞ্চগড়ঃ